
পঞ্চায়েত দুর্নীতি ও ত্রাণ বিতরনে জনগণের তথ্যের অধিকার নিয়ে দেগঙ্গায় অভূতপূর্ব জনসমাবেশ: একটি গ্রাউন্ড জিরো প্রতিবেদন
- 11 October, 2020
- 0 Comment(s)
- 54 view(s)
- লেখক: জুবি সাহা : (লেখাটি দেগঙ্গার আন্দোলনকারীদের যৌথভাবে অনুদিত ও সম্পাদিত )
গত ২০শে মে বাংলা এক ভয়ানক দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যায়। সুপার সাইক্লোন আমফান বাংলার কিছু জেলায় এমন এক তান্ডব চালায় যা বিগত ২০০-৩০০ বছরেও হয়নি। সেই বিভীষিকাময় রাত কাটানোর পরের দিন থেকেই আমরা কয়েকজন উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে সাইকেলে করে পরিদর্শন করতে বেরোই। গ্রামে ঘুরতে গিয়ে এক ভয়ানক চিত্র আমরা অনুভব করি। একে করোনা সংকট (বা তার চেয়েও বড় সংকট অপরিকল্পিত লকডাউন), তার উপরে ঘটে যাওয়া আমফান, এই দুয়ে মিলে মানুষ ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। যেহেতু উত্তর ২৪ পরগনা আমফানে বিধ্বস্ত জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম, প্রচুর ঘরবাড়ি ভেঙে যায় এবং দেগঙ্গা কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ার কারণে চাষবাসেরও ভয়ানক ক্ষতি হয়। লকডাউনে পেট চালানোর মতো যেটুকু রসদ তাঁরা জুগিয়েছিলেন, তাও শেষ হয়ে যায়।
গত ২০শে মে বাংলা এক ভয়ানক দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যায়। সুপার সাইক্লোন আমফান বাংলার কিছু জেলায় এমন এক তান্ডব চালায় যা বিগত ২০০-৩০০ বছরেও হয়নি। সেই বিভীষিকাময় রাত কাটানোর পরের দিন থেকেই আমরা কয়েকজন উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে সাইকেলে করে পরিদর্শন করতে বেরোই। গ্রামে ঘুরতে গিয়ে এক ভয়ানক চিত্র আমরা অনুভব করি। একে করোনা সংকট (বা তার চেয়েও বড় সংকট অপরিকল্পিত লকডাউন), তার উপরে ঘটে যাওয়া আমফান, এই দুয়ে মিলে মানুষ ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। যেহেতু উত্তর ২৪ পরগনা আমফানে বিধ্বস্ত জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম, প্রচুর ঘরবাড়ি ভেঙে যায় এবং দেগঙ্গা কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ার কারণে চাষবাসেরও ভয়ানক ক্ষতি হয়। লকডাউনে পেট চালানোর মতো যেটুকু রসদ তাঁরা জুগিয়েছিলেন, তাও শেষ হয়ে যায়।
এমন অবস্থায় আমরা আন্দাজ করি যে সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হতে পারে। কিন্তু এলাকার অধিকাংশ পঞ্চায়েত মেম্বার এবং প্রধানরা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। সেজন্য আমরা যে কটা গ্রামে পৌঁছাতে পেরেছিলাম, সেখানে গ্রামবাসীদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয় যে তাঁরাও যেন নিজেদের উদ্যোগে একটা ক্ষয়ক্ষতির লিস্ট তৈরি করেন। সেই লিস্ট বিডিও-র কাছে জমা দেওয়া হবে এবং পঞ্চায়েত মেম্বারদের বানানো লিস্টের সঙ্গে কোনো অসামঞ্জস্য পাওয়া গেলে (যা হওয়াটা তখনকার অবস্থায় অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল এবং পরে প্রশাসন ভুয়ো ক্ষতিপূরণ ফেরত নেওয়ায় সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে) গ্রামসভার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা বানানোর দাবি জানানো হবে - এই সিদ্ধান্তে আসেন গ্রামবাসীরা। "কার কি ক্ষতি, কে কি পায়- বিচার হোক গ্রামসভায়" - এই মন্ত্রে বিশ্বাস রেখেই গ্রামবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হন, কেননা গ্রামসভা করাটাই সবচেয়ে স্বচ্ছ উপায়।
এইভাবে চলতে থাকে গ্রামে ঘোরা। ইতিমধ্যেই কিছু ঘটনার উল্লেখ করে রাখা দরকার। এলাকায় বেশ কিছুদিন ইলেক্ট্রিসিটি, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে কোনো খবর পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কয়েকদিন পরে আমরা জানতে পারি যে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ এর কথা ঘোষণা করেছেন। আমফান হয়ে যাওয়ার ৮-১০ দিন অবধি অধিকাংশ জায়গায় পঞ্চায়েত মেম্বার, প্রধানদের দেখা পাওয়া যায়নি এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা অনেকেই ন্যূনতম ত্রিপলটুকুও পান নি। লকডাউন এর অজুহাতে বিডিও অফিসের মেইন গেটেও তালা লাগানো ছিল এবং গ্রামবাসীরা বিভিন্ন প্রয়োজনে গিয়ে ফেরত এসেছেন। গত ৯ই জুন বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের যৌথ উদ্যোগে বিডিও অফিসে একটি ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয় এবং তার ফলস্বরূপ গ্রামবাসীরা গিয়ে নিজের ফর্ম জমা দিতে শুরু করেন। এর এক সপ্তাহ পর আমরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের যে লিস্ট পেয়েছিলাম (মোটামুটি ৮০০ জনের) তা জমা করতে যাই। সেদিন বিডিও অফিস থেকে বলে দেওয়া হয় যে, সবার আবেদন আলাদাভাবে জমা দিতে হবে, এবং তা সেই দিনই করতে হবে। প্রথমত, একদিনে ঐ পরিমাণ আবেদন লিখে জমা দেওয়া অবাস্তব এবং দ্বিতীয়ত, জমা দেওয়ার শেষ তারিখ সম্পর্কিত রাজ্য সরকারের আদৌ কোনো সার্কুলার আছে কিনা আমরা তা জানতে চাই। তাতে আমাদের জানানো হয় যে,স্বয়ং বিডিও, দেগঙ্গা থানার আইসি, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি এবং স্থানীয় MLA, MP-রা মিলে এটা ঠিক করেছেন। যদিও কোনো সার্কুলার আমাদের দেখানো হয়নি এবং সেই বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করানোর পর বিডিও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। তখন আমরা এই বার্তাটি দিয়ে আসি যে তাহলে কিন্তু ৮০০ জন যে যার আবেদন নিয়ে একসাথে আসবেন। মোটের ওপর এই সাক্ষাতের পরে আমরা বুঝে যাই যে গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে উপস্থিত না হলে কাজ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এই গ্রামে গ্রামে ঘোরার সময় থেকেই আমরা গ্রামবাসীদেরকে তাঁদের 'খাদ্য ও কাজের অধিকার' সম্পর্কে সচেতন করার পরিকল্পনা নিই। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে, কিছু পরিবারের সকল সদস্যের এবং বহু পরিবারের কয়েকজন সদস্যের কোনো রেশন কার্ড নেই। লকডাউনে সাময়িক ৬ মাসের জন্য (যা বর্তমানে জুন,২০২১ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে) যে ফুড কুপনের ব্যবস্থা সরকার থেকে করা হয়েছিল, তাও তাঁরা পান নি। কেউ কেউ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে বিডিও অফিসে ফুডকুপন নিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু বিফল হয়ে ফিরে এসেছেন।
লকডাউনের কারণে ভারতবর্ষে কর্মসংস্থানের ভয়াবহ পরিস্থিতি। আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে করা একটি সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, কর্মরত মানুষজনের ৬৭% মানুষ লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন। বহু পরিযায়ী শ্রমিক ভাইবোনেরা নিজেদের গ্রামে ফিরেছেন অত্যন্ত কষ্ট করে। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করি যে ১০০ দিনের কাজ বা NREGA-র গুরুত্ব কতখানি। (পশ্চিমবঙ্গে) সামান্য ২০৪ টাকা মজুরি হওয়া সত্ত্বেও আজ মানুষের কাছে তা যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে সকলেরই অভিযোগ যে, তাঁরা কাজ পান না, পঞ্চায়েত থেকে কাজ দেওয়া হয় না ইত্যাদি। অনেকের তো জব কার্ড পর্যন্ত নেই। কাজ চাইলে ১৫ দিনের মধ্যে কাজ পাওয়া সবার অধিকার- আইনের এই গোড়ার কথাই সাধারণ মানুষ জানেন না আইনটি পাশ হওয়ার ১৫ বছর পরেও। অথচ কাজের প্রয়োজন সকলেরই।
তাই, মূলত তিনটে দাবি নিয়েই ২২শে জুন বিডিও অফিসে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এক, ১০০ দিনের কাজ, দুই আমফানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, এবং তিন, ফুড কুপন বা রেশন কার্ড। এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি থাকে আমাদের। এক, সকলে মিলে বিডিও অফিসে পৌঁছানোর পর আমাদের মধ্যে কেউ প্রতিনিধি হিসেবে আলাদাভাবে ভেতরে আলোচনা করতে যাবে না; বিডিওকে স্বয়ং সকল গ্রামবাসীদের সামনে এসে কথা বলতে হবে। দুই, আমফানে ক্ষতিপূরণ প্রাপকদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তিন, গ্রামসভার আয়োজন করে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা বানাতে হবে। চার, যেহেতু একশো দিনের কাজ মানে শুধুই গর্ত খোঁড়ার কাজ নয়, তাই গ্রামের সম্পদবৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করাতে হবে এবং সেই কাজ যেহেতু আইন অনুযায়ী গ্রামসভার মাধ্যমে ঠিক করা উচিত (যা বাস্তবে কখনোই হয় না), তাই গ্রামবাসীদের নির্ধারিত কাজের প্রকল্প চালু করতে হবে। গ্রামবাসীরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁদের গ্রামে কি কি কাজ হতে পারে। এই দাবিগুলো নিয়ে, দেগঙ্গা ব্লকের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় দু'হাজার জন মানুষ নিজের নিজের ফর্ম (১০০ দিনের কাজের আবেদন , ফুড কুপন, নতুন জবকার্ড বা আমফানের ক্ষতিপূরণের আবেদন ) নিয়ে দেগঙ্গা চিত্ত বসু বাজারের সামনে উপস্থিত হন এবং রোদ-বৃষ্টিকে পরোয়া না করে ৩ কিলোমিটার মিছিল করে দুপুর একটা নাগাদ বিডিও অফিসে উপস্থিত হন। পুলিশ প্রশাসন সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল এবং তারা মেইন গেট আটকে রেখেছিল। ভেতর থেকে প্রস্তাব আসে যে বিডিও দু'-পাঁচজন প্রতিনিধি ছাড়া দেখা করবেন না। সাধারণ মানুষ তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন এবং চাপ দিয়ে মেইন গেট খোলাতে বাধ্য করেন। দফায় দফায় বিক্ষোভ অবস্থান চলতে থাকে এবং চাপের মুখে বিডিও স্বয়ং তাঁর ঠান্ডা ঘরের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে মাইক হাতে জনগণের সম্মুখীন হন। সাধারণ মানুষের সমস্ত দাবি তিনি মানতে বাধ্য হন এবং সকল ফর্ম রসিদ সহ গ্রহণ করার আশ্বাস দেন। শুধুমাত্র আমফানে ২০,০০০ টাকার ক্ষতিপূরণ কারা পেয়েছেন সেই লিস্ট দেখাতে দু ঘন্টা সময় চান। সামান্য একটা লিস্ট দেখাতে তাঁর কেন দু'ঘন্টা সময় লাগবে তা গ্রামবাসীরা জানতে চান। সঠিক কৈফিয়ত দিতে না পারায় সময়টা দু'ঘন্টার পরিবর্তে আধঘন্টায় নেমে আসে। এই বলে তিনি ভেতরে চলে যান এবং দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরও তাঁর দেখা পাওয়া যায় না। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছোন বারাসাত SDPO এবং তার পুলিশ বাহিনী। তিনি ভেতরে ঢুকে বিডিওকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং মাইকে বিডিও বলেন যে, এই ক্ষতিপূরণ প্রাপকের তালিকা RTI না করলে তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না। তখন আমরা বলি যে, তথ্যের অধিকার আইন (RTI) অনুযায়ী প্রশাসনকে যে কোনো সরকারি তথ্য আগ বাড়িয়ে জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে (Proactive Disclosure), তাই আমাদের দাবি যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত। তখন তিনি বলেন যে SDO এবং DM তাঁকে লিস্ট দেখাতে বারণ করেছেন। আমরা বলি যে ওনারা ওপরমহল থেকে সেই নির্দেশ দিয়ে থাকলে তার অর্ডার কপিটা আমাদের দেখান। বিডিও সেটা দেখাতে রাজি হন এবং আবার ভেতরে চলে যান। সময় তখন বিকেল সাড়ে চারটে কি পাঁচটা হবে।
এরপরে গ্রামবাসীরা যার যার ফর্ম গোছাতে লাগেন, কেউ কেউ জেরক্স করতে যান, এইভাবে চলতে থাকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ। ইতিমধ্যে আমরা বারাসাত SDO, উত্তর ২৪ পরগনার DM, বারাসতের DIG, পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও রাজ্যপালের দপ্তরে ঘটনাটা ফোন করে জানাই। তাঁরা সবকিছু শোনেন কিন্তু কোনোরকম আশ্বাস পাওয়া যায় নি। সময় গড়াতে থাকে কিন্তু বিডিওর দেখা পাওয়া যায় না। মহিলারা সামান্য বাথরুম ব্যবহার করতে পারছিলেন না। বারবার বলা সত্ত্বেও ন্যূনতম শৌচাগারের গেটের তালা অবধি খোলা হয় না। এই পরিস্থিতিতে সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে টাকি রোড অবরোধ করেন এবং লিস্ট না দেখানো অবধি অবস্থান তুলবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। গোটা বিষয়টা অবরুদ্ধ পথচারীদের জানানো হলে তাঁদের অনেকেই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। এমনকি কয়েকজন যোগদানও করেন। খবর পেয়ে আরও অনেক গ্রাম থেকে গ্রামবাসীরা আমাদের সাথে যুক্ত হন এবং চাল, ডাল, আলু এনে বিডিও অফিসের প্রাচীরের মধ্যে কমিউনিটি কিচেনের খিচুড়ি রান্না শুরু হয়।
রাত ৮:৩০-৯:০০ টা নাগাদ ৪০-৫০ জন বহিরাগত গুন্ডা বিডিও অফিসে ঢুকে পড়ে। সাইডের গেট দিয়ে অফিস বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে তারা সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে শুরু করে ইঁট বৃষ্টি। বিডিও অফিসের কোলাপসিবল গেটের ভেতর থেকে, জানালা থেকে, ছাদ থেকে নেমে আসে আক্রমণ; বিডিও স্বয়ং, SDPO, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, দেগঙ্গা থানার IC ভিতরে উপস্থিত থাকাকালীন। সকলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন এবং শিশু ও মহিলাসহ অনেকে আহত হন। আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ আহত হই এবং বিডিও অফিসের উল্টোদিকে একটি পেট্রোল পাম্পে আশ্রয় নিই। সেখান থেকেই গ্রামবাসী-সহ ১৬ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় দেগঙ্গা থানায়। আমাদের সঙ্গে একজন নাবালিকাও ছিল। তাকে থানা থেকে রাত্রিবেলা বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং বাকি ১৫ জন গ্রেফতার হই।
এর পরের দিন (২৩শে জুন) কিছু জনের জেল হেফাজত এবং কিছু জনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেয় বারাসাত কোর্ট। আমাদের পক্ষে যে আইনজীবীরা নিঃস্বার্থ ভাবে লড়েছেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানালে কম বলা হবে। মল্লিনাথ গাঙ্গুলি, সুপ্রিয় বিশ্বাস, রাজারাম চক্রবর্তী, মিহির দাস, শামিম আহমেদ, বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য সহ আরও অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই আমরা ৭ দিনের মধ্যে সকলে জামিন পাই। এছাড়াও যে সকল সাথীরা এই সময় জুড়ে বিভিন্নভাবে আমাদের পাশে থেকেছেন, তাঁদের ছাড়া হয়তো আমাদের এই লড়াই আরো দুষ্কর হয়ে উঠতো। আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, জামিনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা করা, যে সকল গ্রামবাসী গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা এবং লকডাউনের কারণে পুলিশের বাধা থাকা সত্ত্বেও বারাসাত এবং গড়িয়ায় আমাদের মুক্তির দাবিতে মিছিল এবং পথসভা করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত আমাদের মুক্তির দাবিতে এবং আন্দোলনের সমর্থনে সোচ্চার হওয়া, যে যেভাবে পেরেছেন আমাদের পাশে থেকেছেন। যে ডেকোরেটর দাদার কাছ থেকে আমরা সেদিন রান্নার বাসনপত্র, মাইক, ইত্যাদি ভাড়া নিয়েছিলাম, তিনি সেগুলো কিছুই ফেরত পান নি। এরপরে অনেক প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও তিনি গ্রামবাসীদের এবং আমাদের পাশে থেকেছেন। ছাড়া পাওয়ার পরে আমরা জানতে পারি বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষ আমাদের জামিনের জন্য প্রার্থনা করেছেন। কেউ হয়তো মানত করেছেন, কেউ কেউ রোজা রেখেছেন। চারিদিকে এত মানুষের ভালোবাসার জেরেই আজ আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি। ধন্যবাদ বললে হয়তো সবার ভালোবাসাকে খাটো করা হবে। এটাই আমাদের শক্তি যোগায় আগামীদিনে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।
খাদ্য ও কাজের অধিকার এবং আমফানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেগঙ্গাবাসীর আন্দোলন এবং আরও অন্যান্য বহু জায়গায় সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ফলে ২৪শে জুন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন। ঘোষণা করেন যে ক্ষতিপূরণ যারা পাচ্ছে তাদের লিস্ট বিডিও অফিসে জনসমক্ষে টাঙিয়ে দিতে হবে, অর্থাৎ, তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী সরকার সক্রিয়ভাবে তথ্য জনগণের সামনে প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। পরবর্তী কালে দেগঙ্গাতেই কেউ কেউ ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরত দেয় যা প্রমাণ করে যে বাস্তবে দুর্নীতি হয়েছিল। স্পষ্টতই প্রশাসনের এই স্বীকারোক্তি আন্দোলনের জয়। দেগঙ্গায় থানার সিভিক ভলেন্টিয়াররা রাত জেগে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের ফর্ম ফিলাপ করে নিয়ে আসেন। আজকের এই দুর্দশায় বহু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের চাপে প্রশাসন কিছুটা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আগামীদিনে এই সকল আন্দোলনের সাথীদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে চাইছেন দেগঙ্গাবাসী। সর্বোপরি ঐক্যবদ্ধ মানুষের আন্দোলনের ধাক্কা ছাড়া এই অচল প্রশাসনের মত এক জগদ্দল পাথরকে নাড়া দেওয়া সম্ভব না তা দেগঙ্গাবাসী বুঝে গিয়েছেন। আগামীদিনে তাঁরা আরও সঙ্গবদ্ধ হয়ে নিজেদের হকের লড়াই লড়তে চাইছেন। নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে "আয় আরো হাতে হাত রেখে, আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি"- এই নীতিতেই ভরসা রাখতে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ভোট বড়ো বালাই। সমস্ত সংসদীয় দলগুলোকে ভোট লড়তে হয়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বব্যাপী করোনা সংকটের কোপ সবচেয়ে বেশী পড়েছে শ্রমিক কৃষক ভাইবোনদের ওপরে। আগামীদিনে তাঁদের খাদ্য ও কাজের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, এই প্রশ্নগুলো রাজনৈতিক ইস্যু হওয়া মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য। এবং সেটা দেশব্যাপী জোরালো আন্দোলন ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক কাঠামোয় গণআন্দোলনের চাপে অনেকটাই পরিবর্তন আনা সম্ভব। সাধারণ মানুষকে তাঁদের নিজেদের ন্যূনতম অধিকার সম্পর্কে সুপরিকল্পিত ভাবেই অবগত করা হয় না। তাঁরা সচেতন হলেই সক্রিয় হয়ে নিজেদের অধিকার লড়াই করে ছিনিয়ে নেবেন। সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করবেন। এটাই তো ছিল বাবাসাহেব আম্বেদকার-এর বার্তা- "Educate, Agitate, Organize"।